গল্পের পাতা

   (১)
দান-বীর
জরাসন্ধ


ট্যাংরাখোলার বাজারে একখানা ছোট-খাটো “বাজে মালের” দোকান। বাপের আমল থেকে ঐটুকুই গণেশ পালের সম্বল। কোন রকমে সংসার চলে। অর্থাৎ চলে না বললেই চলে। তখন যুদ্ধের বাজার। কাপড়, চাল, কেরোসিন জোটাতেই প্রাণান্ত। হঠাৎ একদিন শোনা গেল নদীর পারের সমস্তটা মাঠ জুড়ে আমেরিকানদের ছাউনি পড়ল। তাদের রাক্ষুসে চাহিদা মেটাবার জন্যে দালাল, ফড়ে আর ঠিকাদারে বাজার ছেয়ে গেল। যত ছিল বেকার লোক, তাস পিটে আর তামাক টেনে দিন যেত, কাজ জুটে গেল সবাকার। সবারই হাতে চকচকে নতুন নোট।
গণেশও গিয়ে ধরল ওদের বড়বাবুকে-একটা কনট্রাক্‌টারি চাই। “তুমি পারবে? পুঁজি আছে কিছু?” বড়বাবু হেসে বললেন। “আজ্ঞে, পুজি অতি সামান্যই। ছোট-খাটো অর্ড়ার পেলে দিতে পারব”।
“ছোট-খাটো আর কীই বা আছে? আচ্ছা, ঝ্যাঁটার অর্ডারটা নিয়ে যাও। এক হাজার ঝ্যাঁটা চাই, সাত দিনএর মধ্যে প্রত্যেক্টা আড়াই সের”। ঝ্যাঁটা! গণেশ পালের মনটা দমে গেল। লোকে বলবে ঝ্যাঁটাওয়ালা’।
কিন্তু টাকা যখন চাই অত বাছ-বিচার করলে চলে না! অনেক ভেবে গণেশ রাজী হল। নৌকো, গরুর গাড়ি আর লোকের মাথায় চড়ে দুনিয়ার ঝ্যাঁটা এসে জড় হল তার বৈঠকখানায়। ছেলেরা নাক সিটকায়; গিন্নী তো রেগেই আগুন-“খেতে না জোটে ভিক্ষে কর। এ সব অলক্ষুনে কান্ড কেন বাপু”। দত্ত মশাই মুরুব্বি লোক; বাড়ি বয়ে বলে গেলেন, “কি হে গনেশ শেষকালে তোমার কপালে জুটলো ঝ্যাঁটা?’
যে যাই বলুক, ঝ্যাটার থেকেই গণেশের কপাল ফিরে গেল। ঝ্যাঁটার পরে ঝুড়ি, এবং তারপর বছর না যেতেই টাকাও আস্তে লাগল ঝুড়ি ঝুড়ি। গণেশ পালের ব্যাঙ্কের জমা লাখ ছাপিয়ে উঠল। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ট্যাংরাখোলার বাজারে সবচেয়ে বড় আরত গণেশ পালের। জেলার সদরে উঠেছে তিনতালা। এখন সেখানেই সে থাকে! বাইরেটা তেমনি আছে। সেই আধ-ময়লা ফতুয়াটা এখন ঝুলে একটু বেড়েছে। গণেশ তার নাম দিয়েছে হাপ-পাঞ্জাবি। সাবেকী আমলের বৈঠখানা।ঘরজোড়া তক্তপোশ; তার ওপরে শীতলপাটি। ঠিক সামনেটায় একটা কাঁচের-আলমারী, তার ভেতর একখানা মস্ত বড় ঝ্যাঁটা। সেখনে দাঁড়িয়ে গণেশ নিজ হাতে ধুপ-ধুনো দেয় সকাল-সন্ধ্যা। কেউ যদি প্রশ্ন করে-“আলমারিতে ঝ্যাঁটা কেন?’’ গণেশ কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে “আজ্ঞে, ঐ রুপেই মা লক্ষী আমার ঘরে এসেছেন’’।
ছেলেমেয়েরা ইস্কুল-কলেজে পড়ে। বড় ছেলে তো কথাই কয় না বাপের সঙ্গে, মেয়ে মাঝে মাঝে বলে-“বাবা, ঝ্যাঁটাটা সরেয়ে ফেল। লোকে হাসাহাসি করে”।
গণেশ জিভ কেটে বলল-“সর্বনাশ! বলিস কি তোরো? টাকা যেমন বাড়ল, তার সঙ্গে বেড়ে চলল উমেদার ও দাবিদারের দল। পাড়ায় ঘটা করে সার্বজনীন দুর্গা পূজো হবে। গণেশের নামে চাঁদা পড়ল, পাঁচ-শ টাকা। পূজো-কমিটির প্রেসিডেন্ট নিজেই এলেন আদায় করতে। অনেক আদর-আত্তি, খাতির সমাদারের সঙ্গে গণেশ এগিয়ে দিল একখানা পাঁচটাকার নোট। প্রেসিডেন্ট চীখ রাঙিয়ে বলেন-“আমাদের সঙ্গে তামাসা করছেন?’’
গণেশ জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলল- "ছি-ছি-ছি! আপনারা হলেন মানী লোক। তামাসা করা কি আমার সাজে?"
পূজো-কমিটি রেগে শাসিয়ে বেরিয়ে গেল। এমনি করে আর একদিন ফিরে গেল কাত্যায়নী থিয়েট্রিকাল পার্টির ম্যানেজার। হেড মিষ্ট্রেস সুমিতা দেবি এসে সাহায্য চাইলেন। পাল ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠল। একবার বসে তিনবার দাড়িয়ে, পাঁচবার নমস্কার করে মাথা চুলকে, বের করল দশ টাকার একটা নোট। সুমিতা চোখ কপালে তুলে বললেন- "এ কি করছেন? আমি যে অন্ততঃ হাজার খানেক টাকার আশা নিয়ে এশেছিলাম পালমশাই!"
গণেশ একবারে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে বলল- "আমি নগণ্য লোক; আমাকে অমন ঠাট্টা করলে বড্ড লজ্জা পাই"।
এর পর থেকে গণেশের নামের আগে-পিছে পাড়ার ছেলেরা যে সব বিশেষণ বসাতে লাগল, সেগুলো আর এখানে বলা চলে না।
গণেশের পিসতুতো শ্যালক-ভুজঙ্গভূষণ। ভারী ভাব দু’জনের। বয়সের তফাত অনে, ছাপান্ন আর ছাব্বিশ। কিন্ত মনের কথা চলতো তারি সঙ্গে। ভুজঙ্গ ছিল খবরের কাগজের রিপোর্টার। নানা জায়গায় ঘুরে টাট্‌কা আর মুখরোচক খবর তৈরি করাই ছিল তার পেশা। রিপোর্টার কথাটা সে পছন্দ করত না, নিজেকে বলত জার্নালিস্ট। মাঝে মাঝে গণেশের বাড়ি এলে বেশ কিছুদিন আড্ডা জমত।
সেবার শহরে লাগল ভোট-যুদ্ধ। আইন-সভার সভ্য নির্বাচন হবে। একদিকে দাঁড়িয়েছেন জেল-ফেরৎ দেশসেবক জগৎনারায়ন। আর একদিকে জবরদস্ত জমিদার শিবেশ চৌধুরী। গালাগালি, লাঠালাঠি আর গরম বক্তৃতায় শহর একেবারে সরগরম। এমন সময় ভুজঙ্গ হাজির।
"কি খবর? অনেক কাল যে দেখা নেই!" গণেশ জিজ্ঞেস করল।
"-কত দেশ ঘুরতে হয় দাদা! জার্নালিস্ট মানুষ, এক জায়গায় থাকলে কি চলে?"
"-তারপর হঠাৎ কি মতলবে?’’
ভুজঙ্গ অবাক হয়ে গেল –"সে কি! ইলেকশন্‌ হছে, খবর রাখেন না?" পরদিন টাউন হলে বিরাট সভা! জগৎনারায়ণ বক্তৃতা করবেন। ভুজঙ্গ একরকম জোর করেই গণেশকে ধরে নিয়ে গেল। মঞ্চের উপর আগাগোড়া খদ্দর-মোড়া জগৎনারায়ন বসে আছেন চারিদিক থেকে ঘিরে আছে ভক্তের দল। শহরের গণ্যমান্যলোক কেউ বাকি নেই, দর্শকদের মধ্যে গণেশ আছে সামনের দিকে। ভুজঙ্গের কছাকছি। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, "ওহে ভুজঙ্গ, এ যে দেখছি আমাদের সেই পাগলা জগা! ও আবার জগৎনারায়ণ হল কবে?"
অনেকে কট্‌মট্‌ করে তাকাল। ভুজঙ্গ ঠোটের উপর আঙ্গুল রেখে ফিস-ফিস করে বললে-“চুপ”।
গণেশ গজরাতে লাগল- “আরে রাখো তোমার ইয়ে। ওর কীর্তি আমার তো আর অজানা নেই! থার্ড ক্লাসে দু-দুবার ফেল করবার পর হেডমাস্টার তাড়িয়ে দিলেন। তারপর গাঁজার দোকানে পিকেটিং করে গেল জেলে। ওই বুঝি এখন তোমাদের নেতা?"
পাশের থেকে একটি ছোকরা ধমকে উঠল- “চুপ করুন মশাই!’’ এক বোঝা ফুলের মালা থেকে নামিয়ে জগৎনারায়ণ উঠে দাঁরালেন। হাততালিতে মনে হল সমস্ত হলটা ফেটে পড়বে! ঘন্টাখানেক, যাকে বলে জ্বালাময়ী বক্তৃতার আগুন ছড়িয়ে, শেষের দিকে বললেন-“বন্ধুগণ! আমি একজন নগন্য দেশসেবক। শিবেশ বাবুর মত না আছে অর্থ, না আছে খেতাব, না আছে সরকারী সার্টিফিকেটের জোর। শুধু এখানা ছোট্ট সার্টিফিকেট আমার সম্বল। সেটুকু আমি সবসময় সাথে করে নিয়ে বেড়াই। সেইটাই আজ আপনাদের সামনে খুলে দেখাতে চাই। দেখে যদি আপনারা মনে করেন আমার যোগ্যতা নেই, ভোট চাইব না।" এই বলে জগৎনারায়ণ পেছন ফিরে দাঁডালেন। একজন ভক্ত তার পিঠে কাপড়টা তুলে ধরল- একটা কাটা দাগ। ভক্ত সংক্ষেপে বলল-‘পুলিশের বুক, দেশসেবার পুরুস্কার”।
গণেশ আঁতকে উঠল-“অ্যা! বলে কি? পুলিশের বুক! একেবারে রাতকে দিন! ও তো সেই লিচু থেকে-” তুমুল হাততালিতে গণেশের কথা ডুবে গেল।
ভুজঙ্গ বাড়ি ফিরে দেখল গণেশ অন্ধকার ঘরে বসে তামাক টানছে।
-“কি দাদা, আলোটাও জ্বালতে পারেন নি?’’
গণেশ জবাব দিল না। একমনে অনেকক্ষণ তামাক টেনে আস্তে আস্তে বলল, বুঝলে ভুজঙ্গ, ভেবে দেখলাম জগার রাস্তা ধরলেই ভাল হত। একেই বলে কপাল। টাকা-পয়সা দিয়ে কি হবে? দেখলে একবার মালা আর হাততালির বহরটা?’’
ভুজঙ্গ চোখের কোণে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “কেন, লোভ হচ্ছে নাকি আপনার?’’ -“ আরে, লোভ হলেই হল? ওসব কপালে থাকা চাই। নইলে জগা ব্যাটা স্রেফ ধাক্কা দিয়ে কী মালা আর হাততালিটাই পেলে!”
গণেশের বুকের ভিতর থেকে একটা মস্ত বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। ভুজঙ্গ একবার চেয়ে দেখল, আড়চোখে। দু-একবার মাথা নাড়ল, কিন্তু কথা বলল না।
দিন চার-পাঁচ পরে, সকালবেলা গণেশ কাজে যাবার আয়োজন করেছে, একখানা খবর-কাগজ হাতে ছুটে এল তার মেয়ে সবিতা।
-“বাবা! বাবা!”
-“কি রে?’’
-“এত টাকা দিয়েছ তুমি! কই, আমাদের তো কিছু বল নি?’
-“কোথায় কিসের টাকা?”
-“এখনও বুঝি লুকচ্ছ? এই দেখ না, কাগজে বেরিয়েছে।” গণেশ ব্যস্ত হয়ে বলল, “ কি বেরিয়েছে পড় তো।”
সবিতা পড়ে গেল-“আমরা শুনিয়া আনন্দিত হইলাম যে বিখ্যাত ব্যবসায়ী গণেশচন্দ্র পাল নিজ শহরে একটি মেয়েদের হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা দান করিয়াছেন। ভগবান তাহাকে দীর্ঘজীবী করুন।”
গণেশ কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল একদল ছেলে। একজন হেঁকে বলল, “গণেশ পা-লকি”- আর সবাই গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, “জয়!"  তারপর সবাই মিলে গণেশকে ঠেলে তুলল কাঁধের উপর। গণেশ বেচারী তো ভয়ে অস্তির-‘ আহা, কর কি! কর কি! পড়ে মরব যে-!”
কে শোনে কার কথা!
ছেলেদের পিছনে এলেন বড়দের দল!
-“সাবাস, সাবাস!”
-“খুব চালটা চেলেছ ভায়া!”
“পেটে পেটে এতও তোমার ছিল!”
-“আমাদের মুখ উজ্জল করেছেন আপনি -শহর আজ ধন্য হল আপনার মতন সন্তানকে বুকে ধরে।”-ইত্যাদি প্রশংসার বান ডেকে গেল। গণেশ কিছু বলবার সুযোগ পেল না, শুধু তাকিয়ে রইল ফ্যাল ফ্যাল করে। এমনি করে চলল সারাদিন। বিকেলে এলেন এস ডি ও। বললেন- "আপনার অনারে, মানে সস্মানে, আমরা একটা সভার আয়জন করেছি"
-গণেশ জানালা দিয়ে দেখল বাইরে লোকে লোকারণ্য।
-“এত লোক কেন?
-“ও কিছু না, একটুখানি প্রসেশন।”
গণেশ কাঁদ কাঁদ হয়ে বললে, “আমাকে মাপ করবেন স্যার। মিটিং-য়ে গেলে আমার নিশ্চয়ই হার্টফেল করবে। ও আমি পারব না’- বলে এক ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল! ভুজঙ্গের সঙ্গে দেখা। একাবারে ফেটে পড়ল গণেশ-“কোথায় ছিলে এতক্ষণ? এসব কী হচ্ছে?
ভুজঙ্গ শান্তভাবে জবাব দিল, “মাথা গরম করবেন না দাদা এবার কপাল খুলল আপনার।" অনেক কষ্টে বুঝিয়ে গণেশকে মিটিং-য়ে যেতে রাজী করান হল।
মেয়ে পরিয়ে দিল গরদের জামা-চাদর। ভুজঙ্গ দিলে প্রথম মালা, হেসে বলল, "এই তো কেবল শুরু। আর এই নিন আপনার বক্তৃতা। সবার বলা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়বেন,"-বলে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল হাতে।
সে কি মিটিং। টাউন হল ভেঙে পড়ে আর কি! ঢেকে গেছে নাক পর্যন্ত। গণেশ অতি কষ্টে ঘাড় সোজা করে নাক তুলে বসে আছে। আর একটু হলে দম আটকে যাবে। জগার উপর আর হিংসা নেই। তবুও কেমন একটা ভয়-ভয় ভাব!
শুরু হল বক্তৃতা। কেউ বললেন দানবীর, কেউ বললেন দাতাকর্ণ। প্রবীণ উকিল মহীতোষ বাবু বললেন-“সবচেয়ে বড় দাতা হচ্ছেন তিনি, যাঁর ডান হাত করে কিন্তু বাঁ হাত জানতে পায়না। আমাদের গণেশ আজ সেই আদর্শকে রুপ দিয়েছেন’’
সকলের শেষে গণেশকে জবাব দিতে হল। মালার বোঝা নামিয়ে কোনরকমে পড়ে গেল ভুজঙ্গের সেই কগজখানা। কান-ফাটানো হাততালির মধ্যে শেষ হল বিরাট সভা। একগাড়ি ফুলের মালা নিয়ে বাড়ি ফিরল গণেশ।
হপ্তাখানেক কেটে গেছে। লোকজন এবার পাতাল হয়ে এসেছে। এমন সময় একদিন দেখা দিলেন হেডমিষ্ট্রেস্‌ সুমিতা দেবী আর তাঁর সঙ্গে ইস্কুল-কমিটির আরও দু-একজন। আর এক দফা গুণগানের পর সুমিতা বললেন, “আমাদের টাকাটা।”
গণেশ আকাশ থেকে পড়ল, “কিসের টাকা?”
“আজ্ঞে ঐ পঁচিশ হাজার টাকা, যেটা আপনি ইস্কুলের জন্য দান করেছেন?” ভুজঙ্গ কাছেই বসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে, গণেশ বলল, “এরা বলছেন কি ভুজঙ্গ? আমি নাকি পঁচিশ হাজার টাকা দান করেছে? শোন কথা!”
ভুজঙ্গ কাছেই বসেছিল। তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, আপনারা কি বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।”
সুমিতার গলা কাঠ হয়ে গিয়েছিল, কথা বেরুল না। ইস্কুল কমিটির ভবেশবাবু বললেন, “আপনার কথাই বরং আমরা বুঝতে পারছি না। কে না জানে উনি ইস্কুলের জন্যে পঁচিশ হাজার টাকা দান করেছন? খবর- কাগজে বেরিয়েছে। ঘটা করে মস্ত সভা ডেকে ওকে মানপএ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। আর এখন বলছেন-"
ভুজঙ্গ ধীর ভাবে বলল, “সবই ঠিক। কিন্তু সে সম্বন্ধে উনি কি বলেছেন সেটা আপনারা শুনেছেন কি?” –শুনেছি বই কি?” ওর বক্তৃতাও শুনেছি।”
ভুজঙ্গ পকেট থেকে একটা খবর কাগজ বের করে বলল, “এই দেখুন সেই বক্তৃতার রিপোর্ট। দেখুন ঠিক আছে কিনা?’’
সুমিতা দেবি কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, “হ্যা-এইটেই তো মনে হচ্ছে।”
-“আচ্ছা, তাহলে শুনুন, আমি পড়ে যাছি"।  বলে, ভুজঙ্গ রিপর্টা পড়ে গেল।
“বন্ধুগণ, আপনারা আজ আমাকে যে সম্মান দেখালেন, আমি তার একেবেরেই যোগ্য নই। এমন কিছুই আমি করেনি, যার জন্য আপনাদের কোন প্রসংসা দাবি করতে পারি। এ অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং ছিল না।’
আপনারা আমাকে কেউ বলেছেন, দান-বীর, কেউ বলেছেন দাতাকর্ণ। শুনে যে লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে। আপনারা প্রচার করেছেন আমি মস্ত বড় দান করেছি। আমার সাধ্য কি দান করি? সে সৌভাগ্য কোথায়? সে সঙ্গতিই বা কই?  আমার মত ক্ষদ্র লোকের কি দানের স্পর্ধা সাজে? তবু নিতান্তই বিনা কারনে আপনারা আমাকে যে সম্মান দিলেন তার জন্যে শত কোটি ধন্যবাদ।
পড়া থামিয়ে ভুজঙ্গ বললে, “আশা করি এবার বুঝতে পেরেছেন যে আপনারা মেতে উঠলেও দানের কথা উনি স্রেফ অস্বীকার করে গেছেন। তাই নয় কি?”
সুমিতা ও তার সঙ্গীরা মুখ চাওয়ি-চাওয়ি করতে লাগলেন, জবাব খুজে পেল না। সত্যিই তো একথা গুলোকে বিনয় মনে করে তারা কত হাততালিই না দিয়েছিলেন! তখন কে জানত এর এরকম একটা নিদারুন মানেরও হতে পারে!
আলনার উপরে মালাগুলো তখনও একেবারে শুকোয় নি। সেই দিকে চেয়ে গণেশ পাল বলল, “কিন্তু ওরা যদি মামলা করে?”
“মামলা!”-ভুজঙ্গ হো হো করে হেসে উঠল। “এ আপনার বিজনেস্‌ নয় দাদা, এর নাম জার্নালিজম। আমরা খবরের কাগজের লোক, রীতিমত আটঘাট বেঁধে চলি।”

* * * * * * * * * * * সমাপ্ত * * * * * * * * * * * * *
সংকলনঃ "ছোটদের শ্রেষ্ঠ লেখকের হাসির গল্প"
সুজিত কুমার নাগ সম্পাদিত
__________________________________



                  (২)
পূজোর ছুটিতে বেড়ানো
প্রেমেন্দ্র মিএ

এবারে প্রায় বেরিয়ে পড়েছিলাম বললেই হয়। বলাই বাহুল্য, পূজোর ছুটিতে বেরিয়ে পড়ার কথা বলছি। ছুটিতে বেরুবার উদ্যোগ-আয়োজন কোন্‌ বছর আর না-করি, কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে বেশ কিছুটা আশাপ্রদ ঝিকিমিকি দেখা গেছল উদ্দেশ্যসিদ্ধির। না, লাগেজে বাঁধা-ছাঁদা কি ট্রেনে উঠে বসা অবশ্য হয়নি, তবে সবচেয়ে কঠিন কাজটাই সেরে ফেলেছিলাম মানে, কোথায় যাওয়া হবে, সেইটাই আশ্চর্যভাবে ঠিক হয়ে গেছিল।
ছুটিতে কোথাও বেরুতে হলে গন্তব্যটাই যে’ আসল, এই রুঢ় সত্যটাই অনেকে আমারা ভুলে যাই। অনেকের ধারণা, গন্তব্য একটা ঠিক করলেই হ’ল। ওতে আর কি হাঙ্গামা! কিন্তু যাওযার ঠিকানা বার করা যে অনেকে কঠিন, তা ভুক্তভোগী মাএেই জানেন।
আমার এই চার বৎসরের অভিজ্ঞতাই ধরা যাক্‌ না কেন?
তের শ’ পঁয়ষট্টির থেকে এ বিষয়ে পাকা বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে।
পঁয়ষট্টির রোজনামচার খাতায় দেখছি, দুইটি টাইম-টেবল কেনার কথা রয়েছে। মহালয়া পর্যন্ত যা-যা আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তারও সারাংশ পাচ্ছি। আগ্রা, মথুরা না অজন্তা ইলোরা, এই নিয়ে মতভেদ প্রচন্ড তুফানরুপে মহালয়া পার হয়ে গিয়ে সহসা কুমারিকার নামে শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের রেলের টাইম-টেবিল তখন দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় সব গেছে ভেস্তে।
ছেষট্টিতে মহালয়ার আগেই মূল সমস্যা মিটে গেছে। ঠিক হয়েছে রাঁচিই যাওয়া হবে। কিন্তু মেট্রো না ট্রেনে? মীমাংসা হবার আগেই দেবী দশভুজা অশ্বে না গজে কৈলাসে ফিরে গেছেন।
সাতষট্টিতে স্বাধীনতা দিবস থেকেই বিচার-সভা বসান হয়েছে। সঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে গাইড আর ব্রাড্‌-শ। ফলে গন্তব্য স্থান আর স্থির করা যায়নি। সমুদ্র ও পাহাড়ের, নদী আর অরণ্যের, মানুষের কীর্তি আর প্রকৃতির অকৃএিম শোভার মধ্যে বাছাই করতে না পেরে বিবাদ প্রায় বিচ্ছেদে পৌছবার উপক্রম করেছে।আটষ্টটিতে সবদিক দিয়েই শুভলক্ষন দেখে গেছে গোড়া থেকেই। এবারে বুঝে সুঝে টাইম-টেবিল এনেছি ঠিক পয়লা অক্টোবর।
দোসরা তারিখে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সন্দেহ-দোলায় দুলেছি। ওয়াল্টেয়ার না দ্বারকা?
তেসরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি উওর ও দক্ষিণের মধ্যে। নৈনিতাল না ধনুষকোটি? চৌঠো সব হাঙ্গামা চুকিয়ে একেবারে মধ্যমণী রাজধাণীর ওপরেই মনঃস্থির করেছি। সকাল বেলা টিকিট কাটতে দেবার জন্য টাইম-টেবলটা সবে ওল্টাচ্ছি, এমন সময় সঙ্কটমোচন, বিপদভঞ্জন,পরম প্রামর্শ-বিশারদ শিবু এসে হাজির।
টাইম-টেবলটা তাড়াতাড়ি লুকোতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার শ্যেন-দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেলাম। আবার? আমার ওই সব ঘাঁটছ?-শিবুর গলায় তীব্র ভর্ৎসনা।
ঠিক যেন কোন অশ্লীল আজগুবি নোংরা বই পড়ছিলাম, এমনি অপরাধীর মত কুন্ঠিতভাবে জানাতে হ’ল- না এই দিল্লি কোন্‌ ট্রেনে গেলে সুবিধে হয়, তাই দেখছিলাম।
তুমি দিল্লি যাবে? ওই পূজোর সময়? এই পূজোর সময় কেউ কোথাও যায়? শিবু আমার মুর্খতায় স্তম্ভিত।
বললাম-ত যায় বলেই ত মনে হচ্ছে। নলে টকিটের জন্যে এত মারামারি কিসের।
ও মারামারি করছে আহাম্মুকেরা ! শিবু সোজা রায় দিলে- আর সেই আহাম্মুকদের ভিড়ে কোথাও গিয়ে সুখ আছে!
আমায় নীরব দেখে শিবু বুঝাতে বসল এবার- তোমার দিল্লি যাওয়াটা কি রকম হব একবার ভেবে দেখেছ? প্রথমত, যাবার সময়, নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। হবেই জানে। হাওয়া আপিসের চেয়ে নির্ভুল এ-গণনা। পূজোর সময় ট্রেনের টাইম বুঝে বৃষ্টি হওয়া অবধারিত। তারপর ট্যাক্সি পাবে না ঠিক সময়ে। লোকবল যদি তোমার না থাকে, মালপএ বেঁধে-ছেঁদে ট্যাক্সির খোঁজে মোড়ে মোড়ে ছুটেছুটি করবে। ভাগ্য যদি নেহাত ভালো হয়, তাহলে শেষ মুহুর্তে হয়ত একটা পাবে। সেটা ষ্ট্র্যান্ড রোড কি হ্যারিসন রোড ট্রাফিক জ্যামে জমে যাবে। পূর্ব্জন্মের পূণ্যফল যদি থাকে, তাহলে এক মিনিট থামতে স্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে। সেখানে কুলির তখন দুর্ভিক্ষ, মাল তোলার আগে মাথায় পাগড়ি বাঁধতেই তার অর্ধেক রাজত্ব চাইবে! তারপর মালপএ নিয়ে প্ল্যাটফ্ররমের ঘুরঘুরে গেট দিয়ে ঢুক্তে কার তোরঙ্গ, কার সুটকেসে ধাক্কা খেয়ে কপাল, মাথা ফুলিয়ে ট্রেনের কামরায় গিয়ে যখন পৌঁছবে, তখন দেখবে যারা পৌছাতে এসেছে, তাদের ভিড়ই কামরায় তিলধারণের জায়গা নেই। কোথায় তখন বসবে, কোথায় মাল রাখবে, ঠিক করতেই ঘন্টা বেজে যাবে। মালপএ, এমন কি, তুমি নিজেই সশরীরে পৌছেছ কিনা, তোমার সন্দেহ হবে……..
শিবু একটু দম নেবার জন্যে থামতে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম, তার সদুপদেশে অতিষ্ঠ হয়ে- কিন্তু তার পরে ভাবো দেখি। এক-এক করে সব পৌছোতে-আসল ফালতু লোক নেমে যাবে। যদি দিনের বেলা হয় ত ট্রেন প্ল্যাটর্ফম ছাড়াবার পরই প্রথমে চারিদিকে রেলপথের অসংখ্য আলোর যেন দেওয়ালীর উৎসব। সেই উৎসব ছাড়িয়ে মিষ্টি গাঢ় অন্ধকার…..
শিবু ঝট্‌ করে গলা বাড়িয়ে দিলে একটু ফাঁক পেতে না পেতে..... কিন্তু কামরাটার কথা ভাবো একবার। যে ক্লাসেই যাও যত সব বেয়াড়া, বিদঘুটে সহযাএী, হয় একপাল ছেলে মেয়ে নিয়েই চ্যাঁ-ভ্যাঁ, নয় ভুঁড়িদাস কোন ভোম্বল বাহাদুরের গরম পয়সার অভব্য ঝন্‌ঝনানি…..
শিবুকে ওই ঝন্‌ঝনানির মধ্যে রেখে আমি ধরলাম- কিন্তু সবাই ত ভুঁড়িদাস ভোম্বল বাহাদুর নয়, এই ট্রেনে যেতেই কত অদ্ভুত চমৎকার মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়, এই ভিড়ের মধ্যেই মানুষের নির্ভেজাল চেহারাটা পাওয়া যায়..
এমনি করেই সারা সকালটা আমাদের চিতেন পরচিতেন চলল। আমি থামি ত সে ধরে। সে থামে ত আমি ধরি। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। মেজাজ পরস্প্ররের ক্রমশঃ চড়ছে সপ্তমে। শেষ পর্যন্ত রেগে আমার টাইম-টেবল্টাই কেড়ে নিয়ে শিবু যখন চলে গেল, তখন আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। শিবুও তথৈব চ।
শিবুকে যে সব বাছা বাছা যুক্তি সময়মত মনে পড়লে শোনানো যেত, সেদিন দুপুরটা সেইগুলো ভাবতে কেটে গেল। বিকেলে রাগ করেই বাড়ি বেরুলাম না পাছে শিবু সঙ্গে দেখা হয়। পরের দিন সকালবেলা কিন্তু আকাশের মনটাও প্রসন্ন হয়ে গেছে দেখলাম। অনেক রাত পর্যন্ত শিবুর যুক্তি গুলো খন্ডন করবার পায়তারা মনে মনে করেই বোধ হয় এমনটা হয়েছে ।
সত্যি শিবু কথাগুলো মন্দ বলেছে কি? তার যুক্তি গুলো ক্রমশঃই যেন অকাট্য মনে হছে। এক হিসেবে হড়বড় করে কাল টিকিট কিনতে না দিয়ে ভালোই করেছি। এই পূজোর ভিড়ে বেড়াতে যাওয়া মানে ময়দাঠাসা হওয়ার কোন মানেই হয়না ।
সুপরামর্শ দিয়ে আমার নাকাল হওয়াটা যথা সময়ে নিবারণ করবার জন্যে শিবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসাটা উচিত মনে হল ।
সকালের কাজকর্ম সেরেই তার মেসে গিয়ে হানা দিলাম। কিন্তু শিবু গেল কোথা! তার মেসের ঘরের দরজা দিনরাতই হাট। তার সেই নড়বড়ে তক্তপোশ, ভাঙা আলনা, ঘরময় ছেঁড়া কাগজ, সবই ঠিক আছে। শুধু শিবুই নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি অবাক হয়ে, এমন সময় শিবুর মাসতুতো ভাই গৌরের সঙ্গে দেখা। আমি শিবু কথা জিজ্ঞাসা করব কি, গৌর আমাকে দেখেই প্রায় মারমুখো! কি সব ফুসমন্ত দিয়েছেন বলুন ত শিবুদাকে? লোকটা একেবারে তিড়বিড়িয়ে বেরিয়ে গেল আমাদের গ্রাহ্য না করে! কে গেল? শিবু? কোথায়? আমি হতভম্ব। তা আমরা কি জানি? কাল বিকেলেই একটা সতরঞ্জিতে দুটো ধুতি-পাঞ্জাবি আর গামছা জড়িয়ে বাসে করে হাওড়ায় ছুট। আপনার কাছে কি শুনে শিবুদা সার বুঝেছে যে, পূজোর ভিড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে না বেড়ালে নাকি বেড়াবার কোন মানেই না!

* * * * * * * * *  * * * * * সমাপ্ত * * * * * * * * * * * * * *

সংকলনঃ "ছোটদের শ্রেষ্ঠ লেখকের হাসির গল্প"

সুজিত কুমার নাগ সম্পাদিত
____________________________________


  

         (৩)
উলটো বিচার
সুমথনাথ ঘোষ

অনেক অনেক আগের কথা তখন এ দেশের এক আশ্চর্য রাজা ছিলেন।
যেমনি তার নিয়ম, তেমনি তার বিচার। সবাই তাকে বলতো আজব রাজা।
আজব কান্ড, সব যেন উল্টো, সবাই বলে রাজার মত খেয়ালী আর এদেশে নেই।
প্রজারা তাতে ভয় খেত আবার মজাও পেত।
সেই আজব রাজার গল্প তোমাদের বলছি।
এ রাজ্যের সবই উল্টো।
যেমন ভণ্ড রাজা, তেমনি শঠ ও প্রতারক তার মন্ত্রী ও পারিষদ-বৃন্দ। প্রজা পালনের নামে রাজা করেন প্রজা শোষণ।
ধর্মদন্ড হাতে থাকলেও অধর্মের সাহায্যে তিনি রাজকার্য পরিচালনা করেন।
তাই যারা অন্যায় করে এখানে শাস্তি পায় না, যারা ন্যায়ের পথে চলে তারাই দন্ড ভোগ করে।
ন্যায়নিষ্ঠ ধার্মিক প্রজারা সব সময় আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকে।
কি জানি কার ওপর কখন রাজ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়।
রাজার চেয়ে ভয় করে সবাই বেশী তাঁর অনুচরবর্গকে।
তারা সব সময় পরের ছিদ্র অণ্বেষণ করে বেড়ায়। কার ক্ষেতে ধান জন্মেছে বেশী, কার পুকুরে মাছ হয়েছে অঢেল, কার ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে গোপনে তার তথ্য সংগ্রহ।
তারপর চুরি, জোচ্চুরি, বাটপাড়ী যে যেদিক দিয়ে পারে, তা থেকে আত্মসাৎ করে। আর নিরপরাধ প্রজাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদের চালান দেয় রাজার কাছে বিচারের জন্যে।
যেমন রাজা, তাঁর শাসন করার পদ্ধতিটাও তেমনি চমৎকার। যে অপরাধী, তাকে একটা কাঠের বাক্সের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলা হয়। সেই বাক্সের উপরে যে গর্ত তার মধ্যে থেকে একটা ছোট কাগজের টুকরো টেনে বার করতে।
সেই কাগজে যা লেখা উঠবে তাই হবে রাজার বিচার। ‘বাঁচা’ আর ‘মরা’ এই দু’রকমের কথা দু’টুকরো কাগজে লেখা থাকে, যার ভাগ্যে যা উঠবে, তাকে মেনে নিতে হবে তাই। এর ওপর আর কোন আপীল নেই।
বিচারের নাম শুনলে তাই আতঙ্কে শিউরে ওঠে সকলে।
একদিন এক ধনী বস্ত্র-ব্যবসায়ীকে রাজার সামনে এনে হাজির করেন মন্ত্রী। বললে, হুজুর, এর অপরাধ সাংঘাতিক। এ রাজাশুল্ক ফাঁকী দিয়েছে, যতটা দেবার কথা তার অনেক কম দিয়েছে।
এ গুরুতর অপরাধ সন্দেহ নেই। রাজা তাই সঙ্গে সঙ্গে তার বিচারের দিন ধার্য করে আসামীকে হাজতখানায় বন্দী করে রাখতে হুকুম দিলেন।
কিন্তু মুস্কিল হলো এই, যত বিচারের দিন ঘনিয়ে আসে, তত মন্ত্রীর বুকের ভিতরটা দূর দূর করে।
কি জানি যুদি তার ভাগ্যে ওঠে ‘বাঁচা’। তাহলেই ত আসামী রাজার কাছে সব কথা ফাঁস করে দেবে। এক মন্ত্রী যে তার কন্যার বিবাহের সময় অনেক টাকার বস্ত্র এই মহাজনের কাছ থেকে ধারে কিনেছিল এবং দু’মাস এক বছর করতে করতে প্রায় আড়াই বছর কেটে গেলেও সে দেনা শোধ করেনি-উপরন্ত সেই টাকার জন্যে তাগাদা করাতে মন্ত্রী ওর ঘাড়ে মিথ্যা রাজা সে কথা জানতে পেরে যাবেন।
তাই এই আপদ একেবারে নিস্কন্টক করার জন্যে মন্ত্রী গোপনে সেই বাক্সক্ষককে ঘুষ খাওয়ালে। বললে, ওর ভিতরের দুটো কাগজেই ‘মরা’ এই কথাটা লিখে দিতে হবে, তাহলে যে কাগজেই সে তুলুক মৃত্যু একেবারে সুনিশ্চিত। মন্ত্রী ইচ্ছামত কাজ বাক্সরক্ষক করলে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা মতলবও তার মাথায় গেল।
ঘুষখোরের কি লোভের সীমা আছে! তাই তখনি কারাধ্যক্ষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সে বন্দীর সঙ্গে গোপনে গিয়ে সাক্ষাৎ করলে এবং তার হাতের বহুমূল্য হীরার আংটিটার বিনিময়ে তাকে মন্ত্রী সেই কৌশলের কথাটা ফাঁস করে দিয়ে এলো।
বিচারের দিন সকালে বন্দীকে এনে দাঁড় করিয়ে তার সামনে সেই বাক্সটা রাখা হলো।
রাজার হুকুমে ঘাতক আগে থেকেই তার পাশে হাজির ছিল। মন্ত্রীর বুলের মধ্যে আনন্দের তুফান উঠতে লাগল।
বন্দী প্রথমে ভগবান ও তারপর রাজা ও উপস্তিত জনমন্ডলীকে প্রণাম করে একখানি কাগজ টেনে নিলে বাক্সটা থেকে। কিন্তু ম্রা এই কথাটাকে দেখেই সে তৎক্ষাণাৎ কাগজটা মুখের মধ্যে পুরে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে রাজার দুই চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠলো এবং জনতাও হৈ-হৈ করে উঠলো।
তখন হাত জোড় করে বন্দী রাজাকে বললে, হুজুর, ভয়ে আমি কান্ডাকান্ডা জ্ঞান হারিয়ে এই গর্হিত কাজ করে ফেলেছি, এর জন্যে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।
আর একটি কাগজ ত এখনো অবশিষ্ট রয়েছে –সেটা তুলতেই ত্তার আগেরটাতে কি লেখা উঠেছিল বুঝতে পারা যাবে।
সবাই সায় দিয়ে উঠলো, বললে, সাধু প্রস্তাব। শুধু মন্ত্রীর মুখ ভয়ে পাংশু বর্ণ ধারণ করল।
বন্দী এবার কাগজখানি বাক্স থেকে বার করে সক্লের সামনে উঁচু করে তুলে ধরায় সবাই দেখলে তাতে ‘মরা’ এই কথাটা লেখা।
কাজেই পূর্বের কাগজটা যে ‘বাঁচা’ লেখা ছিল এ বিষয়ে সকলের সঙ্গে রাজা একমত হয়ে তখনই বন্দীকে মূক্তি দিলেন।
শুনলে তো?
আজব দেশের আজব রাজার কান্ড। উল্টো বিচার সবটাই যেন উল্টো তাই না?

* * * * * * সমাপ্ত * * * * * *

সংকলনঃ "ছোটদের শ্রেষ্ঠ লেখকের হাসির গল্প"
সুজিত কুমার নাগ সম্পাদিত
___________________________________